ia-Logo-with-name-01 ia-Logo-with-name-01

প্রচার করো, যদি একটিমাত্র আয়াতও হয়

আমল শিষ্টাচার ব্যক্তিত্ব

আদর্শ সন্তান গঠনে লুকমান (আ.) এর উপদেশাবলী: একটি পর্যালোচনা

Share on:

Poster-07

মা-বাবার উপরই প্রথমত সন্তান গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকে। সে দায়িত্ববোধ থেকেই হযরত লুকমান (আ.) তাঁর সন্তানকে যে কালজয়ী উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে তা উল্লেখ করে কেয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য আদর্শ করে রেখেছেন। তিনি সন্তানদের যে উপদেশ দিয়েছেন তা প্রতিটি মানুষের জন্য বিশেষ করে একজন মুসলমানের আদর্শ সন্তান গঠনের জন্য উত্তম পাথেয় হিসেবে কাজ করবে নিঃসন্দেহে।


আদর্শ সন্তান গঠনে লুকমান (আ.) এর উপদেশাবলী: একটি পর্যালোচনা

 

প্রফেসর ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

ড. মোঃ আব্দুল বারী

 

সন্তান আল্লাহর মহান নে‘আমত। সন্তান পৃথিবীতে পিতা-মাতার মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং জীবনের সাহায্যকারী হিসেবে বিবেচিত। তাঁদের আশা-আকাংখা পূরণ করে। শিশু সন্তানেরা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। মানব সমাজের অমূল্য সম্পদ এই সন্তানদের কিভাবে সার্থকরুপে গড়ে তোলা যায় সে সম্পর্কে সবাই উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বাবা-মা ও অভিভাবকদের অনেক উৎকন্ঠার কারণ সন্তানের পালন ও যথাযথ শিক্ষা প্রদান। মা-বাবার উপরই প্রথমত সন্তান গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকে। সে দায়িত্ববোধ থেকেই হযরত লুকমান (আ.) তাঁর সন্তানকে যে কালজয়ী উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে তা উল্লেখ করে কেয়ামত পর্যমত্ম অনাগত উম্মতের জন্য আদর্শ করে রেখেছেন। তিনি সন্তানদের যে উপদেশ দিয়েছেন তা প্রতিটি মানুষের জন্য বিশেষ করে একজন মুসলমানের আদর্শ সন্তান গঠনের জন্য উত্তম পাথেয় হিসেবে কাজ করবে নিঃসন্দেহে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ

অর্থ, “আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল...।”[1]

একজন পিতা তার প্রিয় সন্তানকে হযরত লুকমান (আ.) এর এসব উপদেশ যা মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন তা শুনিয়ে দেন তাহলে তার জীবনে যখনই কোন অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা ও আসক্তি তৈরি হবে তখন এ নসিহত সমূহ মনে পড়বে এবং অবশ্যই মন্দকাজ পরিহার করবে। ফলে তৈরী হবে একদল আদর্শ নাগরিক। আলোচ্য প্রবন্ধে লুকমান (আ.) এর সে কালজয়ী উপদেশগুলো আলোচনা করা হবে।

 

লুকমান (আ.) এর পরিচয় 

লুকমান ইবন আনকা ইবন সাদূন। লুকমান (আ.) বনি ইসরাইলের অর্ন্তর্ভুক্ত। লোকমান আরব সমাজে একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে বহুল পরিচিত ব্যক্তি। ইমরাউল কায়েস, লবীদ আশা, তারাফাহ প্রমুখ জাহেলী যুগের কবিগণ তাদের কাব্যে লুকমানের নাম উল্লেখ করেছেন। আরবের কোন কোন লোকের কাছে “সহীফা লুকমান” নামে তাঁর জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেত। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে লুকমানের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অনেক মতভেদ রয়েছে। জাহেলী যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিলনা। মুখে মুখে চলে আসা তথ্যই ছিল ইতিহাস। ওয়াহাব ইবনে মুনাবেবহের বর্ণনানুযায়ী লোকমান হযরত আইয়্যুব (আঃ) এর ভাগ্নে ছিলেন। আবার কেউ কেউে তাঁর খালোতো ভাই বলে বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন তাফসীরে রয়েছে যে, তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন এবং দাউদ আলাইহিসসালাম এর সময়েও বেঁচে ছিলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে ‘ইলমও অর্জন করেন। এমনও একটি অভিমত আছে, তিনি বনি ইসরাইলের কাজী তথা বিচারপতি ছিলেন এবং মিসরে বসবাস করতেন। মহান আল্লাহ তাকে অনেক হিকমাত দান করেছিলেন। [2]

وعن ابن عباس كان عبدا حبشيا نجارا

 হযরত ইবনে আববাসের (রাঃ) বর্ণনানুযায়ী লোকমান একজন আবিসিনীয় হাবশী গোলাম। [3] হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) ইকরিমাহ ও খালেদুর রাবে-ঈ ও একই কথা বলেন। হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রাঃ) বলেন- তিনি ছিলেন নুবার অধিবাসী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব বলেন- তিনি মিসরের কালো লোকদের অমত্মর্ভুক্ত ছিলেন। তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি। আরবের লোকেরা সেকালে কালো লোকদেরকে প্রায়ই হাবশী বলত। আর নুবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে ও সুদানের উত্তরে অবস্থিাত এলাকা। লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি। হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন- লুকমান চ্যাপটা নাকবিশিষ্ট, বেঁটে আকারের আবিসিনীয় ক্রীত দাস ছিলেন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন “তিনি ফাটা পা ও পুরো ঠোঁটবিশিষ্ট আবিসিনীয় ক্রীতদাস ছিলেন। [4]

কোন কোন গবেষক লুকমানকে ‘আদ জাতির অর্ন্তর্ভুক্ত ইয়ামানের বাদশাহ মনে করতো। তাদেরমতে ‘আদ জাতির উপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হুদ (আ.) এর সাথে তাদের ঈমানদার যে অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাঁদেরই বংশোদ্ভুত। ইয়ামানে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তাঁদেও অন্যতম শাসক ও বাদশাহ। [5]

লুকমান কোন নবী ছিলেন না; বরং ওলী ও প্রজ্ঞাবান ও বিশিষ্ট মনীষী ছিলেন। ইবন কাসির বলেন যে, প্রাচীন ইসলামী মনীষীবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি নবী ছিলেন না। কেবল ইকরিমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু এটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। ইমাম বগবী বলেন, এ কথা সর্বসম্মত যে, তিনি বিশিষ্ট ফকীহ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন, নবী ছিলেন না। [6] তিনি নবী ছিলেন ? না কি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দাহ ছিলেন এ ব্যপারে বিতর্ক থাকলেও জমহুর ‘ওলামায়ে কিরামের অভিমত হলো লুকমান (আ.) ছিলেন প্রজ্ঞাবান ও আল্লাহর ওলি। তিনি নবী ছিলেন না। [7] আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাঁর কথামালাও বর্ণনা করেছে, যেসব কথায় তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রকে উপদেশ প্রদান করেছেন।

ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন- হযরত কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- আল্লাহাহ পাক হযরত লুকমানকে নবুওত ও হেকমত (প্রজ্ঞা) দু’য়ের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহনের সুযোগ দেন। তিনি হিকমত গ্রহণ করেন। [8]

 

লুকমান (আ.) এর উপদেশাবলী 

সন্তানের প্রতি লুকমান (আ.) এর উপদেশকে মোটামুটি দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। এক. পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কথা ও কাজে বিজ্ঞচিত আচরণ করা দুই. জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মহান আল্লাহর নির্দেশ বাসত্ম বায়ন করা। লুকমান (আ.) তার সন্তানকে উদ্দেশ্য করে যে কালজয়ী উপদেশাবলী প্রদান করেছেন তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

 

প্রথম উপদেশ: আল্লাহর সাথে শিরক না করা 

জ্ঞানগর্ভ বাণীসমূহের মধ্যে সর্বাগ্রে হলো আকীসমূহের পরিশুদ্ধিতার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন করা। একজন সন্তান তাকে অবশ্যই জীবনের শুরু থেকেই আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাসী হতে হবে। কারণ তাওহীদই হল যাবতীয় কর্মকান্ডের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার একমাত্র মাপকাঠি। সে জন্য লুকমান (আ.) ছেলেকে উপদেশের সুচনাতেই আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। যার বর্ণনা মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমে দিয়েছেন,

يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থ, “হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।”[9]

লুকমান (আ.) তাঁর সন্তানকে প্রথম যে উপদেশটি দিয়েছেন তা হলো শিরক[10] থেকে বিরত থাকা। বিশ্বাস কিংবা কাজে কখনোই আল্লাহর সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা বস্ত্তকে শরীক করা যাবে না। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে মূর্তি, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র এমনকি পশুর উপাসনা করার প্রচলন ছিল এবং এখনো আছে। অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে মানুষ মনে করে, এসব জীব কিংবা জড় পদার্থগুলো তাদের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে তারা মানুষ ও বিশ্ব পরিচালনায় এসব জীব ও জড় পদার্থকে সৃষ্টিকর্তার অংশীদার মনে করে এবং সে বিশ্বাস থেকে এসবের উপাসনা করে। এমনকি মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী মুমিন দাবিদার এমন অনেকে আছেন যারা শারিরীকভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে মাথা নত না করলেও প্রকারামত্মরে শিরক করছেন। তারা সম্পদ ও ক্ষমতার পূজা করছেন এবং এসব অর্জনের জন্য যেকোনো ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতি করতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না।

 

শিরকের এই মহাক্ষতির পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হযরত লুকমান তার উপদেশাবলীর শুরুতেই নিজ সন্তানকে শিরক থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শিরক হচ্ছে মহা অপরাধ। শিরক বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আলোকপাত করেছেন। এবং এটিকে বড় জুলুম বলে আখ্যা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা যখন তার বাণী, وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيمَانَهُم بِظُلم অর্থাৎ “তারা তাদের ঈমানের সাথে যুলুমকে একত্র করেনি।”[11]

 

এ আয়াত নাযিল করেন, তখন বিষয়টি মুসলিমদের জন্য কষ্টকর হল, এবং তারা বলাবলি করল যে, আমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে তার উপর অবিচার করে না ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আলোচনা শোনে বললেন,

ليس ذلك ، إنما هو الشرك ، ألم تسمعوا قول لقمان لابنه:يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, “তোমরা যে রকম চিন্তা করছ, তা নয়, এখানে আয়াতে যুলুম দ্বারা উদ্দেশ্য হল, শিরক। তোমরা কি লুকমান (আ.) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছে, তা শোন নি? তিনি তার ছেলেকে বলেছিলেন,

يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ.

অর্থ, “হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।” [12]

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ

“নিশ্চই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।”[13] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ

“নিশ্চয়ই আল্লাহর তাঁর সাথে শরীক করার পাপ ক্ষমা করেন না এতদ্ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন।”[14]

অধিকাংশ ক্ষেত্রে উলুহিয়াত তথা ইলাহ হিসেবে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়। যেমন আল্লাহর সাথে অন্য কারো নিকট দু‘আ করা কিংবা বিভিন্ন প্রকার ইবাদত যেমন যবেহ, মান্নত, ভয়, কুরবানী, আশা, মহববত, আনুগত্য, ভরসা ইত্যাদি কোন কিছু গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা। আল্লাহকে ডাকার মত অন্যকে ডাকা, আল্লাহকে ভয় করার মত অন্যকে ভয় করা, তাঁর কাছে যা কামনা করা হয়, অন্যের কাছে তা কামনা করা। তাঁকে ভালোবাসার মত অন্যকেও ভালোবাসা। যেমন, মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা অথবা অনুপস্থিত ও অক্ষম লোকের নিকট সাহায্য চাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এছাড়াও এ ধরনের আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো শিরকের অর্ন্তর্ভুক্ত।

 

সুতরাং সন্তানকে উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে তাওহীদের উপর অটল ও অবিচল থাকতে এবং শিরক থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিতে হবে। কারণ, শিরক হল, এমন এক যুলুম বা অন্যায়, যা মানুষের যাবতীয় আমলকে বরবাদ করে দেয়। সুতরাং একজন পিতার প্রথম দায়িত্বই হলো সন্তানকে শিরক বিষয়ে সতর্ক করা ও তার পরিনতি সম্পর্কে অবহিত করা।

 

দ্বিতীয় উপদেশ: মাতাপিতার প্রতি সদাচরণ করা 

লুকমান (আ.) তার ছেলেকে আল্লাহর ইবাদত করা ও তার সাথে ইবাদতে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করার পর পরই মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার উপদেশ দেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ.

অর্থ, “আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে [সদাচরণের] নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে, তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন-তো আমার কাছেই।”[15] অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا”এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে” [16]

 

সদ্ব্যবহার বলা হয়, মাতা-পিতার প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়া, তাদের সাথে সুন্দর ও কোমল আচরণ করা, তাঁদের প্রতি দয়া পরবশ হওয়া ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা, তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং তাঁদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁদের সেবাযত্ন করা ও তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করা। [17]

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদাতের পরপরই মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যাবহারের বিষয়ে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। মাতা-পিতার অধিকার সন্তানের উপর অনেক বেশি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُلْ لَّهُمَا أُفٍّ وَّلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيْماًوَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْراًرَّبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِيْ نُفُوْسِكُمْ إِنْ تَكُوْنُواْ صَالِحِيْنَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلْأَوَّابِيْنَ غَفُوْراً

 

“আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভাল করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল”। [18]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِيْ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلاَ تُطِعْهُمَا إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ.

“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দিব যা কিছু তোমরা করতে।”[19]

 

পবিত্র কুরআনের বাণীগুলোকে বিনয়াবনত অমত্মকরণে মূল্যায়ন করতে হবে। এখানে কোন দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করা হ’তে বিরত থাকতে হবে। আয়াতগুলোতে সাধারণভাবে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি অবিচল থাকা ও সাথে সাথে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, তাদের সেবা-যত্ন ও আনুগত্যের নির্দেশও দান করা হয়েছে। অবশ্য আয়াতের প্রারম্ভেই পিতা-মাতা উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মাতার কষ্টের কথা উল্লেখ করার তাৎপর্য এই যে, মাতার পরিশ্রম ও কষ্ট অপরিহার্য ও জরূরী। গর্ভ ধারণের সময় কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট সর্বাবস্থায় ও সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাতাকেই সহ্য করতে হয়।

মা তাকে গর্ভধারণ, দুধ-পান ও ছোট বেলা লালন-পালন করতে গিয়ে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট সইতে হয়েছে। তারপর তার পিতাও লালন-পালনের খরচাদি, পড়া-লেখা ও ইত্যাদির দায়িত্ব নিয়ে তাকে বড় করেছে এবং মানুষ হিসেবে ঘড়ে তুলেছে। তাই তারা উভয়ে সন্তানের পক্ষ হতে সদাচার ও খেদমত পাওয়ার অধিকার রাখে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلمفَقَالَ مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِى قَالَ « أُمُّكَ ». قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ « ثُمَّ أُمُّكَ ». قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ « ثُمَّ أُمُّكَ ». قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ « ثُمَّ أَبُوكَ

“আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার সাহচর্যে সদাচারণ পাওয়ার সবচেয়ে অগ্রাধিকারী কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, অতঃপর কে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর তোমার পিতা।”[20] প্রত্যেক ঈমানদারের উপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হল, মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া আদায় করা। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা, কোন প্রকার খারাপ ব্যবহার না করা এবং তাদের উভয়ের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা। পিতা-মাতা সন্তানের কাছ থেকে আনুগত্য, সদাচরণ ও খেদমত পাওয়ার অধিকারী- এই শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের দেয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

 

তৃতীয় উপদেশ: মাতা-পিতা শিরক বা কুফরের আদেশ করলে তা মানা যাবে না 

লুকমান (আ.) তার সন্তানকে পিতা-মাতার আনুগত্য, তাদের সাথে সুন্দর ও কোমল আচরণ করা, তাঁদের প্রতি দয়া পরবশ হওয়া ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার উপদেশ প্রদানের পাশাপাশি তাদের আনুগত্যের সীমারেখা উল্লেখ করে বলেন, মাতা-পিতা যখন তোমাকে শিরক বা কুফরের নির্দেশ দিবে, এ বিষয়ে তাদের আনুগত্য করা যাবেনা। সে ক্ষেত্রে উপদেশ দেয়া হয়েছে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করার। মহান আল্লাহ তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,

وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

অর্থ, “আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না। এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে আচরণ করবে সদ্ভাবে। আর আমার অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।” [21]

 

আল্লামা ইবনে কাসীর (র.) আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘যদি তারা উভয়ে তোমাকে পরি-পূর্ণরুপে তাদের দ্বীনের আনুগত্য করতে বাধ্য করে, তাহলে তুমি তাদের কথা শুনবে না এবং তাদের নির্দেশ মানবে না। তবে তারা যদি দ্বীন কবুল না করে, তারপরও তুমি তাদের সাথে কোন প্রকার অশালীন আচরণ করবে না। তাদের দ্বীন কবুল না করা তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাতে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। তুমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করবে। আর মুমিনদের পথের অনুসারী হবে, তাতে কোন অসুবিধা নাই। ’[22]

এ কথার সমর্থনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী করে, তিনি বলেন,

لا طاعة لأحد في معصية الله ، إنما الطاعة في المعروف

“আল্লাহর নাফরমানিতে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলবে না। আনুগত্য-তো হবে একমাত্র ভালো কাজে।”[23]

আল্লাহর নাফরমানিহয় না, এমন কোন নির্দেশ যদি মাতা-পিতা দিয়ে থাকে, তখন সন্তানের উপর তাদের নির্দেশের আনুগত্য করা ওয়াজিব। আর যদি আল্লাহর নাফরমানি হয়, তবে তা পালন করা ওয়াজিব নয়।

 

চতুর্থ উপদেশ: প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা 

লুকমানতার ছেলেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দেয়ার সাথে সাথেকোন প্রকার অন্যায় অপরাধ করতেও নিষেধ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আর মনে রাখবে কোন নেক-কাজ তা যতই ছোট হোক না কেন, তাকে তুচ্ছ মনে করা যাবে না এবং কোন খারাপ-কাজ তা যতই ছোট হোক না কেন, তাকে ছোট মনে করা যাবে না এবং তা পরিহার করতে কোন প্রকার অবহেলা করা চলবে না। মহান আল্লাহ এ বিষয়ে তাঁর উপদেশ উল্লেখ করে বলেন,

يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ.

অর্থ, “হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা [পাপ-পুণ্য] যদি সরিষা দানার পরিমাণও হয়, অত:পর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমান সমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ।”[24]

 

আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. বলেন, অন্যায় বা অপরাধ যতই ছোট হোক না কেন, এমনকি যদি তা শস্য-দানার সমপরিমাণও হয়, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা‘আলা তা উপস্থিত করবে এবং মীযানে ওজন দেয়া হবে। যদি তা ভালো হয়, তাহলে তাকে ভালো প্রতিদান দেয়া হবে। আর যদি খারাপ কাজ হয়, তাহলে তাকে খারাপ প্রতিদান দেয়া হবে। [25]

 

তাফহীমুল কোরআনের প্রনেতা يَأْتِ بِهَا اللَّه এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর জ্ঞান ও তার পাকড়াও এর বাহিরে কেউ যেতে পারে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে কিন্তু তার কাছে তা সুস্পষ্ট। বিশাল আকাশে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্মসত্মরে পতিত কোন জিনিস তোমার কাছে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। কিন্তু আল্লাহর কাছে তা রয়েছে উজ্জ্বল আলোর মধ্যে। কাজেই তুমি কোথাও কোন অবস্থায় এমন কোন সৎ বা অসৎ কাজ করতে পারো না যা আল্লাহর আগোচরে থেকে যায়। তিনি কেবল তা জানেন তা-ই নয়, বরং যখন হিসাব-- নিকাশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের নড়াচড়ার রেকর্ডও সামনে নিয়ে আসবেন। [26]

মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِن كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ

“আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপনকরব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট।”[27] মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন যত ছোট কিছুই হোক না কেন তা হাজির করবেন এবং সঠিক বিচার করে ভালোর প্রতিদান ভাল আর মন্দের প্রতিদান মন্দ দ্বারা দিয়ে দিবেন।

 

মহান আল্লাহএ প্রসঙ্গে অন্যত্র আরো বলেন:

يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْفَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُوَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ.

অর্থাৎ “ সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হয়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।”[28]

 

আল্লাহ তা'য়ালার সমেত্মাষ ও মহববত অর্জনের অন্যতম শর্ত হল অন্যায় অপরাধকে মারাত্মক ভয়াবহ মনে করা এবং গোনাহ থেকে বেচে থাকার অবিরাম সাধনা করা। গোনাহের প্রতি বেপরোয়া মনোভাব বা গোনাহের কাজকে জায়েজ মনে করলে বা তওবার প্রতি উদাসীন মানসিকতায় ঈমান নষ্ট হয় এবং মানুষকে কুফুরীর সত্মরে উপনীত করে। মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হল ঈমান। সুতরাং ঈমানের হেফাজতের জন্য গোনাহ-এর ব্যাপারে সর্বদা ভীত-সন্ত্রসত্ম থাকতে হবে, গোনাহ থেকে বেচে থাকার জন্য তৎপর থাকতে হবে এবং তওবার হালতে জীবন অতিবাহিত করতে হবে।

গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে সার্বিকভাবে প্রয়াস চালাতে হবে। এ প্রসংগে আল্লাহতা'য়ালা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

“হে মুমিনগণ! তোমাদের সংশোধনের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদেরই উপর। তোমরা যদি সঠিক পথ অবলম্বন কর, তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর কাছেই তোমাদের সকলের ফিরে আসা। এরপর তিনি সে সম্পর্কে জানাবেন যা তোমরা করতে।”[29]

 

পঞ্চম উপদেশ: সালাত কায়েমের উপদেশ

লুকমান (আ.) তাঁর ছেলেকে একটি গুরুত্বপুর্ণ ইবাদাত সালাত কায়েমের উপদেশ দেন। মহান আল্লাতা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ অর্থাৎ, “হে আমার প্রিয় বৎস সালাত কায়েম কর”, [30]

আল্লাহ মানুষকে তার ইবাদাতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। শুধু মানুষ নয়; মানুষ ও জ্বীন-উভয় জাতিকে আল্লাহ তাঁর ইবাদত তথা তার দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন-

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

অর্থাৎ “আমি মানব ও জ্বীন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” [31]

ফলে তিনি মানুষের জন্য কিছু দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক ইবাদত প্রচলন করেছেন। দৈহিক ইবাদতের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান ইবাদত হল সালাত। আল্লাহর একাত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রেসালাতের স্বাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত হল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। ঈমানের পরে প্রত্যেক মুমিন নর ও নারীর উপরে সবচেয়ে বড় ফরয ইবাদত হলো, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত বা নামায সময়মত আদায় করা। আরবী ভাষায় সালাত অর্থ প্রার্থনা বা দোয়া করা। ইসলামের পরিভাষায় সালাত অর্থ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো নির্ধারিত পদ্ধতিতে কু রুকু সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর যিকর ও দোয়া করা। কুরআন ও হাদীসে এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব আর কোনো ইবাদতকে দেওয়া হয় নি। কুরআন মজীদে প্রায় ৭০ স্থানে আল্লাহ সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে আমরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারি। অসংখ্য হাদীসে সালাতের গুরুত্ব বোঝান হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের পরেই সালাতের কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন,

بُنِيَالإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ، وفي روايةصيام رمضان والحج

“ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো: বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা (দাস) ও রাসুল বা প্রেরিত বার্তাবাহক, সালাত (নামায) কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসের সিয়াম (রোজা) পালন করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ আদায় করা।”[32]

 

একজন মুমিনের যতক্ষণ হুশ রয়েছে, ততক্ষণ তার দায়িত্ব হলো সময় মত সালাত আদায় করা। কুরআনুল কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:

حافظوا على الصلوات والصلاة الوسطى وقوموا لله قانتينفإن خفتم فرجالا أو ركبانا فإذا أمنتم فاذكروا الله كما علمكم ما لم تكونوا تعلمون.

“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের, এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। যদি তোমরা আশংকিত থাক তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, আর যখন নিরাপদ বোধ করবে তখন যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।” [33]

 

সালাতকে আমরা দায়িত্ব মনে করি। আসলে সালাত দায়িত্ব নয় সুযোগ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছেন, দিনের মধ্যে পাঁচবার তাঁর সাথে কথা বলে, মনের সকল আবেগ তাঁকে জানিয়ে, তাঁর রহমত, বরকত লাভ করে আমরা ধন্য হব। কুরআনের আলোকে জানা যায় যে সালাতই হল সকল সফলতার চাবিকাঠি। কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ বলেছেন:

قد أفلح المؤمنونالذين هم في صلاتهم خاشعون

“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যমত্ম বিনয় ও মনোযোগিতার সাথে সালাত আদায় করেন।”[34]

অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছে, قد أفلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى “সেই ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে, যে নিজেকে পবিত্র করে এবং নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করে।”[35]

সালাত হলো, মানুষের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। সালাতই মানুষকে পরিশীলিত করে এবং মানবতার পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয়। সালাতের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানসিক দৃঢ়তা ও ভারসাম্য অর্জন করেন এবং মানবীয় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন। কুরআনুল কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:

إن الإنسان خلق هلوعا إذا مسه الشر جزوعا وإذا مسه الخير منوعا إلا المصلين الذين هم على صلاتهم دائمون

“নিশ্চয় মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই অস্থিরচিত্ত ও ধৈর্যহারা। বিপদে পড়লে সে অধৈর্য ও হতাশ হয়ে পড়ে। আর কল্যাণ বা সম্পদ লাভ করলে সে কৃপণ হয়ে পড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম সালাত আদায়কারীগণ (তারা এই মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন। ) যারা সর্বদা (নিয়মিতভাবে) সালাত আদায় করেন।” [36]

সালাত এমন একটি এবাদত যাকে আল্লাহ তাঁর মাঝে এবং তাঁর বান্দার মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যসত্ম করেছেন। সালাতের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সাথে দেয়া প্রতিশ্রম্নতির বার বার প্রতিফলন ঘটায়। সে তার প্রভু বা স্রষ্টাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সে তার প্রতিশ্রম্নতি পালন করে যাচ্ছে। এ সালাতের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ কংটকমুক্ত হয়। সালাত ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শামিত্ম, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মমতাবোধ ফিরিয়ে আনে। গড়ে উঠে সামাজিক ঐক্য। সালাতের মাধ্যমে ছগীরা তথা ছোট ছোট গুনাহগুলো হতে পরিত্রাণ লাভ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়।

 

তাই সালাতের যাবতীয় আরকান ও ওয়াজিবগুলি সহ সালাত কায়েম করা প্রত্যেক মুমিনের উপর ওয়াজিব; সালাতে কোন প্রকার অবহেলা না করে, সালাতের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া এবং খুশুর সাথে সালাত আদায় করা ওয়াজিব। সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রত্যেক পিতা-মাতার উপর দায়িত্ব ছোটকাল থেকেই সন্তানকে নামাজের উপদেশ দেয়া ও গুরুত্ব প্রদান করা। আর তাইতো রাসূলুল্লাহ (স.) এরশাদ করেছেন,

قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: علموا لصبي الصلاة ابن سبع سنين واضربوه عليها ابن عشر

অর্থাৎ “ সন্তানের বয়স সাত বছর হলে নামায শিক্ষা দাও! আর দশ বছর হলে নামাযের জন্য তাকে প্রহার কর।”[37]

                                                                                    

ষষ্ঠ উপদেশ: সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা

 তিনি তাঁর সন্তানকে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখার পরামর্শ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ

অর্থাৎ “তুমি ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ কর।” [38]

আমর বিল মারূফ এবং নেহি আনিল মুনকার” ইসলামের একটি অত্যবশ্যকীয় দায়িত্ব। একটি মৌলিক সত্মম্ভ এবং এ ধর্মের অনন্য বৈশিষ্ট্য। সংস্কার ও সংশোধনের বিশাল মাধ্যম। তার মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। তার মাধ্যমে শামিত্ম ও সমৃদ্ধির বিস্তার ঘটে। কল্যাণ ও ঈমান বিসত্মৃতি লাভ করে।

সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাধা দান মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। মুমিন নিজে কেবল সৎকাজ করবে না, বরং সকলকে সে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালাতে হবে। কেননা, তারা পরস্পরের বন্ধু। অতএব একবন্ধু অপর বন্ধুর জন্য কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করতে পারে না। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহবলেন-

وَٱلمُؤۡمِنُونَ وَٱلمُؤۡمِنَٰتُ بَعضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعض يَأۡمُرُونَ بِٱلمَعرُوفِ وَيَنهَوۡنَ عَنِٱلمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُ

“মুমিন নারী ও পুরুষ তারা পরস্পরের বন্ধু। তারা একে অপরকে যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত পরিশোধ করে এবং আল্লাহও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক যাদের প্রতি অচিরেই আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।”[39]

কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মুমিনের অন্যতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সকল স্থানে অন্যান্য গুণাবলীর পাশাপাশি গুরুত্বপুর্ণ গুণ হিসেবে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অবতারণা করা হয়েছে। কুরআনে এসেছে:

التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

 “তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, আল্লাহর গোলামীর জীবন-যাপনকারী। তাঁর প্রশংসা উচ্চারণকারী, তাঁর জন্য যমীনে পরিভ্রমণকারী, তাঁর সম্মুখে রুকু ও সিজদায় অবনত। সৎ কাজের আদেশ দানকারী, অন্যায়ের বাধা দানকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষাকারী। হে নবী, তুমি এসব মুমিনদের সুসংবাদ দাও।”[40]

আর এই উম্মতের ব্যাপারেও হুশিয়ারি আছে ঠিক একই রকম,

عَنْحذيفةَ رضي اللَّه عنه أَنَّ النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قال: والَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بالْمعرُوفِ، ولَتَنْهَوُنَّ عَنِ المُنْكَرِ، أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللَّه أَنْ يَبْعثَ عَلَيْكمْ عِقَابا مِنْهُ، ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلاَ يُسْتَجابُ لَكُمْ الترمذي وقال: حديثٌ حسنٌ

হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জীবন, তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ করবে আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। যদি না কর, তাহলে আল্লাহতোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। অত:পর তোমরা তাকে ডাকবে আর তোমাদের ডাকের সাড়া দেয়া হবে না। [41] বিনম্র ভাষায় তাদের দাওয়াত দাও, যাদের তুমি দাওয়াত দেবে তাদের সাথে কোন প্রকার কঠোরতা করো না।

 

সপ্তম উপদেশ:বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করো 

লুকমান (আ.) সন্তানকে বিপদে-আপদে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিয়েছেন। যখন সমস্যার সম্মুখীন হবে তখন করণীয় হলো ধৈর্য ধারণ করা এবং ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।

মহান আল্লাহ বলেন, وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ “যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর।”[42]এই আয়াত দ্বারা এটাই স্পষ্ট হয় যে এই কাজটি করা অনেক কঠিন এবং এই কাজটি করতে অনেক ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রয়োজন হয় সাথে সাহসেরও, কারন এই কাজটি করতে গেলে অনেক বিপদ আসবে বাঁধা আসবে আর এই সব বাঁধা-বিপদকে সরিয়েই এগিয়ে যেতে হবে তবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাব আমরা।

 

আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যারা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ ও মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ করবে তাকে অবশ্যই কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে এবং অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। যখন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে তখন করণীয় হল, ধৈর্যধারণ করা ও ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। রাসূল ( সা.) বলেন,

المؤمن الذي يخالط الناس ويصبر على أذاهم ، أفضل من المؤمن الذي لا يخالط الناس ولا يصبر على أذاهم

“যে ঈমানদার মানুষের সাথে উঠা-বসা ও লেনদেন করে এবং তারা যে সব কষ্ট দেয়. তার উপর ধৈর্য ধারণ করে, সে যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা বা লেনদেন করে না এবং কোন কষ্ট বা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না তার থেকে উত্তম।”[43]

মহান আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ অর্থ, “নিশ্চয় এগুলো অন্যতম সংকল্পের কাজ।”[44]অর্থাৎ, মানুষ তোমাকে যে কষ্ট দেয়, তার উপর ধৈর্য ধারণ করা অন্যতম দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ।

 

ধৈয্যের অর্থ 

১. তাড়াহুড়ো না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বরিত ফল লাভের জন্য অস্থিও না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা।

২. তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগোক্রামত্ম না হওয়া।

৩. বাধা-বিপত্তির বীরোচিত মোকাবেলা করা এবং শামত্ম চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা।

৪. দুঃখ বেদনা, ভারাক্রামত্ম ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া ও ধৈর্য্যওে একটি অর্থ।

৫. সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খাহেশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা।

 

শত প্রচেষ্টার পরও বিপদাপদ চলে আসলে তাতে ধৈর্য্যধারণ করতে হবে এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা কর্তব্য। মূলত সাবের বা ধৈর্য্যধারণকারী সে সব লোককে বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেই ‘সবর’ অবলম্বন করে। হাশরের দিন বলা হবে “ধৈর্য্যধারণকারীরা কোথায়?” এ কথার সংগে তিন প্রকার সবরকারী দাঁড়াবে যাদের বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।

 

বিপদে ইন্নালিল্লাহ পড়লে সওয়াব, অথের্র প্রতি খেয়াল রাখলে অমত্মরে শামিত্ম পাওয়া যায়মনে রাখতে হবে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণকারীকে অবশ্যই-অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। ধৈর্যের কোন বিকল্প নাই। ধৈর্য ধারণ করা হল, একটি মহৎ কাজ। আল্লাহ তা‘আলা ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন। সুতরাং সন্তানকে ধৈর্যের উপদেশের বিকল্প নেই।

 

অষ্টম উপদেশ: ব্যবহারে শিষ্টাচার ও বিনয় অবলম্বন 

লুকমান (আ.) তার সন্তানকে মানুষের সাথে কিরুপ ব্যববহার করতে হবে সে নির্দেশনা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ অর্থ, “আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না।”[45]অর্থাৎ অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ঠিক না। অন্যকে ছোট এবং নিজেকে বড় মনে করো না বরং মানুষের সাথে সবসময় বিনয় ও নম্রভাবে কথা বলবে। যদি এটা না করো ভাল আমলকে এটা ধ্বংস করে দিবে।

 

বিনয় ও নম্রতা মানুষের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনয় মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সহায়তা করে। বিনয়ীকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। যে যত বেশী বিনয়ী ও নম্র হয় সে তত বেশী উন্নতি লাভ করতে পারে। এ পৃথিবীতে যারা আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন লাভ করে আছেন তাদের প্রত্যেকেই বিনয়ী ও নম্র ছিলেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র মানুষ ছিলেন শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স.)। তিনি ছিলেন বিনয় ও নম্রতার মূর্তপ্রতীক। তাইতো মহান আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবে وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘আর নিশ্চয়ই তুমি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’[46]

অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘তুমি তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও’[47]মহান আল্লাহ বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষদের প্রশংসায় বলেন,

 

وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً، وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَاماً، إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرّاً وَمُقَاماً-

 

“দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা রাত্রি অতিবাহিত করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত থেকে ও দন্ডায়মান হয়ে এবং যারা বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর, নিশ্চয়ই এর শাস্তি নিশ্চিত বিনাশ। নিশ্চয়ই তা অবস্থান ও আবাসস্থল হিসাবে অত্যমত্ম নিকৃ”। ’[48]

 

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,

يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ

“হে আয়েশা! আল্লাহ তা‘আলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার দরুন দান করেন না; আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা দান করেন না”। [49]

 

রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’। [50]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

 تبسمك في وجه أخيك لك صدقة

“তোমার অপর ভাইয়ের সম্মুখে তুমি মুচকি হাসি দিলে, তাও সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে।”[51]

বিনয় ও নম্রতার বিপরীত শব্দ হ’ল ঔদ্ধত্য, কঠোরতা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্রের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব। এ পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি, খুন-রাহাজানি সহ যত অশান্তির সৃষ্টি হয় তার মূলে রয়েছে ঔদ্ধত্য, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি।

 

নবম উপদেশ: অহঙ্কার ও গর্বভরে পদচারণা না করা

লুকমান তাঁর ছেলেকে পরবর্তীতে যে উপদেশ দিয়েছেন তা হলো পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গীতে চলো না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 وَلا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحاً

“অহংকার ও হঠকারিতা প্রদর্শন করে জমিনে হাটা চলা করবে না।” [52]

কারণ, এ ধরনের কাজের কারণে আল্লাহতোমাকে অপছন্দ করবে। এ কারণেই মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ

“নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।”

 

অর্থাৎ যারা নিজেকে বড় মনে করে এবং অন্যদের উপর বড়াই করে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের পছন্দ করে না। আল্লাহকোন আত্মম্ভরী ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। এ ব্যপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولاً

“পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ পৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” [53]

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَالَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِالآخِرَةِ قُلُوبُهُم مُّنكِرَةٌ وَهُم مُّسْتَكْبِرُونَلاَ جَرَمَ أَنَّ اللّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ.

 

“তোমাদের সত্যিকারের উপাস্য হচ্ছেন,, এক আল্লাহ, কিন্তু যারা পরকালকে বিশ্বাষ করে না তাদের অমত্মর সত্য বিমুখ এবং তারা অহংকারী। নি:সন্দেহে আল্লাহতাদের গোপন ও প্রকাশ্যে সকল কর্ম সম্পর্কেই পূর্ন অবগত আছেন। নিশ্চই আল্লাহ সেই লোকদের কখনো ভালবাসেন না যারা আত্ম-অহংকারে নিমজ্জিত”। [54] মহান আল্লাহ আরো বলেন,

تُسْكَن مِّن بَعْدِهِمْ إِلَّا قَلِيلًا وَكُنَّا نَحْنُ الْوَارِثِينَ

আমি কত গ্রাম-শহর ও এলাকাই না ধ্বংস করেছি যার অধিবাসীরা স্বীয় জীবিকা ও ধন-সম্পদ নিয়ে গর্ব অহংকার করতো। তাদের পর আর কমসংখ্যক লোকই সেখানে বসবাস করেছে। অবশেষে আমিই চূড়ামত্ম মালিক রয়েছি। [55] সুতরাং গর্ব অহংকার সর্ব অবস্থায় পরিত্যজ্য।

 

দশম উপদেশ:  হাটা চলায় গর্ব ও অহংকার পরিহার করা

আল্লাহ রাববুল আলামীন ধীর-স্থিরতা ও নম্রতা অবলম্বন পূর্বক সংযত হয়ে চলাফেরা করার জন্য মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। অহংকার করা সম্পূর্ণ হারাম। যারা অহংকার ও বড়াই করে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল করীমে বলেন:

 وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ

“আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।” [56]

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلاً-

“পৃথিবীতে দম্ভভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি পদভারে ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনও পর্বতসম হ’তে পারবে না”। [57]

তুমি তোমার চলাচলে স্বাভাবিক চলাচল কর। খুব দ্রম্নত হাঁটবে না আবার একেবারে মন্থর গতিতেও না। মধ্যম পন্থায় চলাচল করবে। তোমার চলাচলে যেন কোন প্রকার সীমালঙ্ঘন না হয়। চলাচলে যেন কোনো প্রকার সীমা লঙ্ঘন না হয় সে দিকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

 

একাদশ উপদেশ: নরম সূরে কথা বলা

লুকমান হাকীম তার ছেলেকে নরম সূরে কথা বলতে আদেশ দেন। মহান আল্লাহতা‘আলা বলেন,

وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ

“তোমার আওয়াজ নিচু কর।” [58]

আর কথায় কোন তুমি কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না। বিনা প্রয়োজনে তুমি তোমার আওয়াজকে উঁচু করো না। মহান আল্লাহতা‘আলা বলেন,

إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

“নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ।” [59]

 

এখানে কথা বলার সময় বাড়াবাড়ি না করে নরম আওয়াজে কথা বলার উপদেশ দেয়া হয়েছে। কেননা, বিকট আওয়াজে কথা বলা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে একেবারেই অপছন্দীয়। আল্লামা মুজাহিদ বলেন, ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ। অর্থাৎ, মানুষ যখন বিকট আওয়াজে কথা বলে, তখন তার আওয়াজ গাধার আওয়াজের সাদৃশ্য হয়। আর এ ধরনের বিকট আওয়াজ মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট একেবারেই অপছন্দনীয়। বিকট আওয়াজকে গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করা প্রমাণ করে যে, বিকট শব্দে আওয়াজ করে কথা বলা হারাম। কারণ, মহান আল্লাহতা‘আলা এর জন্য একটি খারাপ দৃষ্টামত্ম উপস্থাপন করেছেন। প্রয়োজনের চেয়ে অধিক উচ্চ আওয়াজে কথা বলা হতে বিরত থাকবে। কারণ, অধিক উচ্চ আওয়াজ বা চিৎকার করা হল গাধার স্বভাব। আর দুনিয়াতে গাধার আওয়াজ হল, সর্ব নিকৃষ্ট আওয়াজ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إذا سمعتم أصوات الديكة ، فسلوا الله من فضله ، فإنها رأت ملكاً ، وإذا سمعتم نهيق الحمار فتعوذوا بالله من الشيطان ، فإنها رأت شيطاناً

“মোরগের আওয়াজ শোনে তোমরা আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ কামনা কর, কারণ, সে নিশ্চয় কোন ফেরেশতা দেখেছে। আর গাধার আওয়াজ শোনে তোমরা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কারণ, সে অবশ্যই একজন শয়তান দেখেছে।”[60]

 

 

পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান সমাজের অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘরে ঘরে দাউ দাউ করে জ্বলছে অশামিত্মর আগুন। ডিস, সিডি, ইন্টারনেট, মোবাইল, সাইবারক্যাফে ইত্যাদির মাধ্যমে পর্ণোছবি দেখা, বস্নাক মেইলিং, ইভটিজিং বাড়ছে মহামারীর ন্যায়। অশালীন পোশাক, রূপচর্চা, ফ্যাশন, অবাধ মেলামেশা, যত্রতত্র আড্ডা, প্রেমালাপ, মাদক, পরকীয়া, অবৈধ যৌনাচার ও সন্ত্রাসের সয়লাব চলছে সমাজের সর্বত্র। বসত্মতঃ এ ধরনের সামাজিক অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় পুরো সমাজকে এক চরম ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

 

নানা অত্যাচারে অতিষ্ঠ পিতা-মাতা যেন যিম্মী হয়ে আছেন তরুণ-যুবক সন্তান-সন্ততির কাছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও যেন পিতামাতার মতই অসহায়। আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন সংশিস্নষ্টরা। সমাজের অবক্ষয়ের কারণে যুব সমাজের কল্যাণময় অবদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলে। বর্তমানে যে সকল পরিবার সন্তানের প্রতি উদাসীন, সন্তানের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করেন না, তাদের অধিকাংশের যুবক-তরুণ সন্তান-সন্ততি উচ্ছৃঙ্খল ও অনৈতিক জীবন যাপন করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে।

এদের মাঝে ধর্মীয় অনুশীলন, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা, পারিবারিক বোঝাপড়া, পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নেই বললেই চলে। ধনী শ্রেণী বৈধ-অবৈধ পন্থায় টাকা উপার্জন করে এবং ভোগ-বিলাসেই মত্ত থাকে অধিকাংশ সময়। সন্তান চাইলেই তারা টাকা-পয়সা দিয়ে এবং পোশাক-পরিচ্ছদ, দামি মোবাইল, গাড়ি ইত্যাদি কিনে দিয়েই দায়মুক্ত হয়। অন্ধস্নেহে সন্তানের কোন ভুল-ত্রুটি অভিভাবকের চোখে ধরা পড়ে না। বর্তমান সময়ের অভিভাবকগণ এসব ব্যাপারে আগের মত সিরিয়াস নন, তারা কেবল অর্থের পিছনে ছুটছেন। সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের একমাত্র বা প্রধান লক্ষ্য। ধর্মকর্ম, নীতি-নৈতিকতা তাদের কাছে গৌন হয়ে গেছে। সন্তান-সন্ততিকে সময় দেয়ার মত ফুরসত নেই, সন্তান-সন্ততিও তাই কথা শুনছে না। ছোট-বড় সকলে তথাকথিত প্রগতি বা উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়ায় সমাজ ব্যবস্থা দ্রম্নত নষ্ট ও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে দরিদ্র শ্রেণীর সন্তানরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অশিক্ষা-কুশিক্ষা পেয়ে বেড়ে ওঠে। সন্তান একটু বড় হ’লেই তারা অর্থ উপার্জনে লাগিয়ে দেয়। এই দুই শ্রেণী সাধারণত নিজেরাও ধর্মকর্ম করে না, সন্তানকে খুব একটা শিক্ষা দেবারও প্রয়োজন অনুভব করে না।

 

টীকা ও তথ্যনির্দেশ


[1]. আল-কুরআন, সূরা লুকমান : ১৩।

[2]. ইবন কাছীর, ইমামুদ্দিন আবুল ফিদা ইসমাইল, তাফসীরুল কুরআনুল কারীম, (রিয়াদ: দারুস সালাম, তাবি), খ.৩, পৃ.২১৯৫-৯৬।

[3]. আল-‘আইনী, বদরুদ্দীন আল-হানাফী, উমদাতুল কারী ফি শারহী সহীহলি বুখারী (http://www.ahlalhdeeth.com.-১৪২৭) খ.২৩, পৃ.৩৯২

[4]. কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), (মদীনা: বাদশাহ ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ কমপেক্স কতৃক সংরক্ষিত-১৪৩৭ হি.), খ.২, পৃ.২২১৩-১৪।

[5]. পূর্বোক্ত।

[6]. পূর্বোক্ত।

[7]. পূর্বোক্ত। , شجرة لقمان بن حكيم .فتاوى الشبكة الإسلامية معدلة খ.৯, পৃ.১৯২৭।

[8].পূর্বোক্ত।

[9]. সূরা লুকমান, আয়াত -১৩।

[10]. রব ও ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সহিত আর কাউকে শরীক সাব্যস্ত করার নামই শিরক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উলুহিয়াত তথা ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়। যেমন আল্লাহর সাথে অন্য কারো নিকট দু‘আ করা কিংবা বিভিন্ন প্রকার ইবাদাত যেমন যবেহ, মান্নাত, ভয়, আশা, মহববত ইত্যাদির কোন কিছু গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা। আল্লাহকে ডাকার মত অন্যকে ডাকা, আল্লাহকে ভয় করার মত অন্যকে ভয় করা, তাঁর কাছে কামনা করা হয়, অন্যের কাছে তা কামনা করা। তাঁকে ভালোবাসার মত অন্যকেও ভালোবাসা। ‘‘মানুষের মধ্যে এমন একদল লোক আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে শরীক বানিয়েছে এবং তাদেরকে এমনভাবে ভালবাসে যেমন আল্লাহকে ভালোবাসা উচিত, আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাধিক ভালবাসে’’। (সূরা আল বাকারা: ১৬৫) আল্লাহর জন্যে সম্পাদনযোগ্য ইবাদতসমূহের যে কোন একটি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা।

[11]. সূরা আল-আন‘আম, আয়াত- ৮২।

[12].     আল-খাজেন, ‘আলাউদ্দিন ‘আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন ইব্রাহিম আল-বাগদাদী, لباب التأويل فى معانى التنزنل , তাফসীরুল খাজেন )বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৭৯), খ.২, পৃ. ১৫৪, ইমাম আবি আ‘ওয়ানাহ ইয়া‘কুব ইবন ইসহাক, مسند ابى عوانة, (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ) খ.১, পৃ.৭৪।

[13]. সূরা আল মায়েদা, আয়াত -২।

[14]. সূরাতুন নিছা, আয়াত ৪৮।

[15]. সূরা লোকমান, আয়াত ১৪।

[16]. সূরা লুকমান, আয়াত ১৫।

[17].     সালেহ ইবন আব্দুর রহমান ইবন হুমাইদ, আব্দুর রহমান ইবন মুহাম্মাদ ইবন মালুহ এর তত্ত্বাবধনে রচিত (দারুল ওয়াসীলা: মাসু’আহ নাদরাতুন না’ঈম, ৩য় সং, ১৪২৫ হিজরী, ২০০৪ইং). ৩খ, পৃ. ৭৬৭; ইমাম বুখারী, আবু ‘আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল, আল-আদাবুল মুফরাদ, (সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওয়াকফ ও ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৪০১), পৃ.১০, ১১

[18]. সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত , ২৩- ২৫। &

[19]. সূরা আল-আনকাবূত, আয়াত ৮।

[20]. ইমাম বুখারী, আবু ‘আবদুল্লাহ -মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল, সহীহুল বুখারী (বৈরুত: দারু ইবন কাছীর, ১৯৮৭), হাদীস নং, ২২২৭।

[21].সূরা লুকমান, আয়াত -১৫।

[22]. ইবন কাছীর, পূর্বোক্ত, খ.৩, পৃ.২১৯৫।

[23]. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, মুসনাদেু আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, (http://www. alsunnah.com), খ.১, পৃ.২৭২।

[24]. সূরা লুকমান, আয়াত -১৬।

[25]. ইবন কাছীর, পুর্বোক্ত, খ.৩, পৃ.২১৯৫-৯৬।

[26]. মাওদুদী (র.), সাইয়্যেদ আবুল আ‘লা, তাফহীমুল কুরআন, (banglabookpdf.blogspot.com/), খ.১১, পৃ.১২০। 

[27]. সূরাতুল আম্বিয়া, আয়াত-৪৭ ।

[28]. সূরাতুল যিলযাল, আয়াত- ৬-৮।

[29]. সুরা আল-মায়েদা, আয়াত -১০৫।

[30]. সূরা লুকমান, আয়াত -১৭।

[31]. সূরাতুয যারিয়াত, আয়াত- ৫৬।

[32].    আবু ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল বুখারী, সহীহুল বুখারী, (দারু ইবন কাছীর-১৯৮৭), খ.১, পৃ.১২।

[33]. সূরা আল-বাক্বারা , আয়াত -২৩৮-২৩৯।

[34]. সূরাতুল মু‘মিনূন, আয়াত-১-২।

[35]. সূরাতুল আ‘লা, আয়াত -১৪-১৫।

[36]. সূরাতুল মা‘আরিজ, আয়াত- ১৯-২২।

[37]. ইবন খুজাইমাহ, মুহাম্মদ ইবন ইসহাক আবু বকর আন-নাইসাপূরী, সহীহ ইবন খুজাইমাহ, (বৈরুত-আল-মাকতাবুল ইসলামী-১৯৭০), খ.২, পৃ.১০২, হাদীস নং-১০০২, তিরমিযি, মুহাম্মদ ইবন আবু ঈসা, সুনানুত তিরমিযি, (বৈরুত-দারু ইহইয়া আত-তুরাছ আল্-ইসলামী, তাবি), খ.২, পৃ.২৫৯, হাদীস নং-৪০৭।

[38]. সূরা লোকমান, আয়াত -১৭।

[39]. সুরা আত-তাওবা, আয়াত -৭১।

[40]. সুরা আত-তাওবা, আয়াত -১১ -১২।

[41]. তিরমিযি, মুহাম্মদ ইবন আবু ঈসা, সুনানুত তিরমিযি, (বৈরুত-দারু ইহইয়া আত-তুরাছ আল্-ইসলামী, তাবি), খ.৪ পৃ.৪৮৬।

[42]. সূরা লোকমান, আয়াত -৭।

[43]. আহমাদ ইবনুল হুসাইন ইবন আলী ইবন মুসা আল-বায়হাকী, সুনানুল বায়হাকী আল-কুবরা (মাকতাবাতু দারুল বায, মক্কা-১৯৯৪), খ.১০, পৃ৮৯।

[44]. সূরা লুকমান, আয়াত- ১৭।

[45]. সূরা লোকমান, আয়াত- ১৮।

[46]. আল-কুরআন, সূরা আল-কালাম, আয়াত -৪।

[47]. আল-কুরআন, সূরাতুশ শুয়ারা, আয়াত -১৫।

[48]. আল-কুরআন, সূরাতুল ফুরক্বান, ৬৩-৬৬।

[49].     আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, সহীহ মুসলিম (বৈরুত: দারুল জাইল), খ.৮, পৃ.২২, হাদীস নং-৬৭৬৬।

[50]. সহীহ মুসলিম, পুর্বোক্ত, পৃ.২১, হাদীস নং-৬৭৫৭।

[51]. সুনান আত-তিরমিজী, পূর্বোক্ত, খ.৪, পৃ.৩৩৯।

[52]. সূরা লোকমান, আয়াত- ১৮।

[53]. সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত -৭।

[54]. সূরাতুন নাহল , আয়াত --২৩।

[55]. সূরাতুল কাসাস, আয়াত -৫৮।

[56]. সূরা লুকমান, আয়াত ১৯।

[57]. সূরা বনি ইসরাঈল, ৩৭।

[58]. সূরা লুকমান, আয়াত ৯।

[59]. সূরা লোকমান, আয়াত ১৯।

[60]. তাফসীর ইবন কাসীর, পূর্বোক্ত, খ. ৩ পৃ. ৪৪৬ ।